পদ্মা সেতু: সুদিন আনবে সেতু, অপেক্ষা দক্ষিণে

কর্তৃক TzuqiivcDuX
০ মন্তব্য ৭৩ ভিউস

ট্রাকচালক স্বপন মিয়ার মতো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকেরাও পদ্মা সেতুর অপেক্ষায়। তাঁরা সেতু চালু হলে সহজে শস্য, সবজি ও মাছ ঢাকায় পাঠাতে পারবেন। উদ্যোক্তারা অপেক্ষায় পুঁজি নিয়ে, কাঁচামাল ও পণ্য আনা-নেওয়া সহজ হলে তাঁরা কারখানা করবেন। তরুণেরা অপেক্ষায়, তাঁরা চান কাজের খোঁজ। পরিবহন ব্যবসায়ীরা আরও বেশি বাস নামাতে চান। তাঁদের আশা, যোগাযোগ সহজ হলে মানুষের চলাচল বাড়বে।

এই অপেক্ষা গত ২০ বছরের। ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতুর প্রাক্‌-সম্ভাব্যতা যাচাই করে। সেই বছর থেকেই সেতু নির্মাণের আশা তৈরি হয়। পদ্মা সেতুর কাঠামো দাঁড়িয়ে যাওয়ায় স্বপ্নও বাস্তব রূপ পাচ্ছে। সরকার ও সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞদের আশা, জটিল কাজ সব শেষ হয়ে যাওয়ায় আগামী দেড় বছরের মধ্যে সেতুটি চালু করা যাবে।

পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণের জেলার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর কী প্রভাব পড়বে, তা জানতে চেয়েছিলাম সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হানের কাছে। অধ্যাপক রায়হান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের আরেক অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকারের সঙ্গে ২০১০ সালে সেতু বিভাগের জন্য পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে একটি সমীক্ষা করেন। সেলিম রায়হান বলেন, ‘আমাদের সমীক্ষায় উঠে এসেছিল যে সেতুটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়াবে। এ সমীক্ষায় রেল সংযোগের বিষয়টি ছিল না। পরে যেহেতু রেল যুক্ত হয়েছে, সেহেতু সেতুটি আরও বেশি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’

কীভাবে সেতুটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তার ব্যাখ্যাও দেন সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ঢাকা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার। এই বাজারের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াবে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতু তৈরিতে যে ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হচ্ছে, রেল সংযোগে যে ৩৯ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় হবে, সেটাও জিডিপিতে প্রভাব ফেলবে। কারণ, প্রকল্পের ব্যয়ের টাকা জিডিপিতে যোগ হবে। পরোক্ষভাবে চাহিদা বাড়াবে পণ্য ও সেবার।

banner

বঙ্গবন্ধু সেতু কী প্রভাব ফেলেছিল: যমুনার ওপর দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারের এই সেতু উত্তরের জেলাগুলোর সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ সহজ করে। ফলে বগুড়া বা রংপুরের কৃষক সকালে খেত থেকে যে ফুলকপি তোলেন, মধ্যরাতে তা ঢাকায় এসে যায়। রাজশাহীর খামারিদের তাজা রুই মাছ রাজধানীর বাজারে বাজারে বিক্রি হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবুল বায়েস ২০০৭ সালে জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের (জেবিআইসি) জন্য বঙ্গবন্ধু সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে একটি সমীক্ষা করেন। এতে সেতু হওয়ার আগে ও পরে সাতটি গ্রামের মানুষের ওপর জরিপ করা হয়। দেখা যায়, যে পাঁচটি গ্রাম সেতুর সুফল পেয়েছে, তাদের ফসলের দাম বাড়ার হার, আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য কমার হার বেশি। অন্যদিকে দুটি গ্রাম সেতুর সরাসরি সুফল পায়নি। সেখানে ফসলের দাম বাড়ার হার, আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য কমার হার ততটা বেশি নয়। যেমন সরাসরি সেতুর সুফল পাওয়া গ্রামে সেতু চালুর পর ছয় বছরে চালের দাম বছরে ৬ শতাংশ হারে বাড়ে। বিপরীতে সুফল না পাওয়া গ্রামে বাড়ে ৩ শতাংশ হারে। সব ফসলের দামের ক্ষেত্রেই এ চিত্র দেখা যায়।

পদ্মা সেতু চালু হলে উত্তরের মতো ফসলের বাড়তি দাম পাওয়া যাবে বলে মনে করেন দক্ষিণের কৃষকেরা। তাঁদের এই আশার দিকটি উঠে এসেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) গত মে মাসের এক সমীক্ষায়। এতে মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৭৫০ জনের সাক্ষাৎকার নেয় আইএমইডি, যাঁদের ৯৫ শতাংশ বলেছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে কৃষিপণ্যের পরিবহন সহজ হবে।

মাদারীপুরের শিবচরের কৃষক বাদশা মিয়া মুঠোফোনে বলেন, সেতুর অভাবে তাঁদের পণ্য ঢাকায় পাঠাতে খরচ বেশি পড়ে। সময় বেশি লাগে। সেতুটি চালু হলে সহজে বাজার ধরা যাবে।

পিছিয়ে খুলনা ও বরিশাল: অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উত্তরের বিভাগ রাজশাহী ও রংপুরের চেয়ে পিছিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের খুলনা ও বরিশাল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী, ওই বছর দেশে মোট অর্থনৈতিক স্থাপনা ছিল ৭৮ লাখের কিছু বেশি। এর মধ্যে তখনকার সাতটি বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে কম স্থাপনা ছিল সিলেট, বরিশাল ও খুলনায়। যেমন রংপুরে অর্থনৈতিক স্থাপনার সংখ্যা ছিল ১০ লাখের বেশি। বরিশালে তা ছিল সাড়ে ৩ লাখের মতো। একসময়ের শিল্পসমৃদ্ধ খুলনাও রংপুরের চেয়ে পিছিয়ে।

পিছিয়ে থাকার জন্য অবকাঠামোর দুর্বলতাকেই দায়ী করেন ব্যবসায়ীরা। খুলনা শিল্প ও বণিক সমিতির (কেসিসিআই) সভাপতি কাজী আমিনুল হক বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের অন্যতম সমস্যা হলো ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের সময় ও দূরত্ব। পদ্মা সেতু হলে ওই সমস্যা অনেকাংশে কেটে যাবে।

ইতিমধ্যেই পদ্মা সেতু ঘিরে বেসরকারি বিনিয়োগ শুরু হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা জাজিরা প্রান্ত থেকে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে ঘিরে এবং আশপাশের এলাকায় জমি কিনতে শুরু করেছেন। ঢাকার এই পাশে আবাসন প্রকল্পের জমি কেনা হচ্ছে। ফলে জমির দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে। যেমন ২০০৭ ও ২০০৮ সালে পদ্মা সেতুর জন্য যখন জাজিরার চারটি মৌজায় ১ হাজার ৭০১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়, তখন সরকার-নির্ধারিত দর (মৌজা রেট) ছিল শতাংশপ্রতি ৭ হাজার ১৫৪ টাকা। বর্তমানে সরকার-নির্ধারিত দর শতাংশপ্রতি সাড়ে ৮৭ হাজার টাকা। অবশ্য জমি কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, জমির বাজার মূল্য আসলে সরকারি দরের ২ থেকে ৩ গুণ বেশি।

জাজিরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোবারক আলী সিকদার মাসট্রেড নামে একটি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিক। তিনি গার্মেন্টপল্লি, কৃষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, শ্রমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও কারিগরি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য ১০০ বিঘা জমি কিনেছেন। তাঁর কেনা জমি জাজিরায় পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে। জমিতে এখন বালু ভরাটের কাজ চলছে।

মোবারক আলী সিকদার বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক দিয়ে পিছিয়ে। এই জনপদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করবে পদ্মা সেতু। তিনি বলেন, ‘সুযোগটি কাজে লাগাতে আমার মতো অনেক উদ্যোক্তা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমি যে বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি, তা বাস্তবায়িত হলে চার থেকে পাঁচ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।’

সেতুর ‘রিটার্ন’ কত: পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে প্রতিবছর কী পরিমাণে যানবাহন চলাচল করবে, তা নিয়ে ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কয়েকটি সমীক্ষা হয়। সমীক্ষাগুলো করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এবং সেতু বিভাগের জন্য সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)।

এডিবির সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০২২ সালের শুরুতে যদি পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হয়, তাহলে ওই বছর সেতু দিয়ে প্রতিদিন চলাচল করবে প্রায় ২৪ হাজার যানবাহন। সংখ্যাটি প্রতিবছরই বাড়বে। ২০৫০ সালে প্রায় ৬৭ হাজার যানবাহন প্রতিদিন চলবে পদ্মা সেতু দিয়ে। এর সুফল পাবেন ২১ জেলার মানুষ। এডিবির সমীক্ষায় আরও বলা হয়, পদ্মা সেতু হলে দক্ষিণের জেলাগুলোতে যেতে বাসের ক্ষেত্রে গড়ে দুই ঘণ্টা ও ট্রাকের ক্ষেত্রে ১০ ঘণ্টা সময় সাশ্রয় করবে।

এডিবি গত সেপ্টেম্বর মাসে পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে সার্বিক প্রভাবের অংশে উল্লেখ করা হয়, সেতুটি দেশের জিডিপির হার বাড়াবে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়াবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। দারিদ্র্য বিমোচনের হার বাড়াবে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ।

সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সেতুটি শুধু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা নয়, দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুই সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করবে। একটি বাগেরহাটের মোংলা ও অন্যটি পটুয়াখালীর পায়রা। প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ের একটি জরুরি অবকাঠামো পদ্মা সেতু।

জাপানের সহযোগিতা সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ২০০৯ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগের অর্থনৈতিক প্রভাব বা ইকোনমিক রেট অব রিটার্ন (ইআরআর) দাঁড়াবে বছরে ১৮ থেকে ২২ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে সেটা বাড়তে পারে। কারণ হিসেবে সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার আগে সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, ইআরআর হবে ১৫ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে তা সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে।

পদ্মা সেতুতে কত টাকা ব্যয় হচ্ছে ?

পদ্মা সেতু তৈরিতে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে, তা ওঠাতে লাগবে প্রায় ৩৫ বছর। যানবাহন চলাচলে নির্দিষ্ট হারে টাকা বা টোল আদায় করে এ অর্থ ওঠাবে সরকার।

সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু তৈরিতে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে, তা ওঠাতে লাগবে প্রায় ৩৫ বছর। যানবাহন চলাচলে নির্দিষ্ট হারে টাকা বা টোল আদায় করে এ অর্থ ওঠাবে সরকার।

পদ্মা সেতু জিডিপি কতটা বাড়াবে, এর অর্থনৈতিক ‘রেট অব রিটার্ন’ কত—এসব জটিল হিসাবে যেতে রাজি নন সরকারি চাকরিজীবী রফিকুল ইসলাম সরদার। তাঁর বাড়ি বরিশালের গৌরনদী উপজেলায়। ৯ মাস বয়সী সন্তানকে নিয়ে তাঁর স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে থাকেন।

রফিকুল এখন মাসে একবার বাড়ি যান। তিনি বলেন, ‘সেতু হয়ে যাক, প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলে বাসে উঠব। তিন ঘণ্টা পর মেয়ের মুখ দেখব।’

You may also like

Leave a Comment

Meherpurer Alo: Your trusted source for timely, accurate, and insightful news from Meherpur and beyond.

প্রকাশক ও সম্পাদক

প্রধান সম্পাদকঃ জনাব হাজী মোঃ আলফাজ উদ্দিন
প্রধান উপদেষ্টাঃ জনাব মোঃ আলা উদ্দিন( আলা)

প্রধান প্রকাশক ও সম্পাদকঃ জনাব মোঃ জাকির হোসেন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদকঃ জনাব মোঃ সেলিম রেজা
আইন বিষয়ক সম্পাদকঃ অ্যাডভোকেট মোঃ জিল্লুর রহমান (জিল্লু)
বার্তা সম্পাদকঃ মোঃ মাহবুল ইসলাম

সর্বশেষ পোস্ট

© ২০২৫ মেহেরপুরের আলো । সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত।
কারিগরি সহযোগিতাঃ দেশি হোস্টিং, আমঝুপি, মেহেরপুর।